Saturday, March 21, 2009

'উত্তাল মার্চ'


 

'উত্তাল মার্চ'


জাহিদ আকোন



দুই হাজার নয়ের মার্চ।
আমি ছাব্বিশ বছরের তরুণ
       বাংলাদেশের তরুণ।
       রাজধানীতে বাস।
সপ্তাহের পাঁচদিন কার্যদিবস
       দুইদিন ছুটি।
সকাল আটটায় অফিস।
'বিবিসি'-'এবিসি' শুনতে শুনতে চলি
       'বন্ধু পরিবহনে' চেপে
       কার্যালয় অভিমুখে
মুঠোফোনের এফ-এমের হেডফোন কানে।


'পিলখানা-কান্ড' কি হত্যাযজ্ঞ না বিদ্রোহ?
       এই প্রশ্ন পরিষ্কার হচ্ছে দিনে দিনে।
কী বিভৎস!
কী নির্দয়!
আর একসাথে এত সেনা অফিসার কি হত হয়েছেন
       কখনও পৃথিবীর কোথাও?
মনে হয় - 'না'!

আন্তর্জাতিক রূপ নিচ্ছে পশ্চিমের অর্থনৈতিক মন্দা।
বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছেন বিদেশে।
       বড় চিন্তার কথা!
সরকারের কাছে ব্যবসায়ী সমাজের আর্থিক সাহায্যের আবেদন
       যাতে এই খাত বিপদে না পড়ে।

'গঙ্গা ব্যারেজ' নাকি হবে পদ্মায়!
              ভালোই তো!
দক্ষিণ-পশ্চিমের মানুষের কৃষিকাজ সেচবিমুখ থাকবে না আর।
রাজশাহী নগরীর পদ্মার জলহীন বালুময়তা ঘুচবে এবার।

বড় এক রাজনৈতিক দলের বড় একজনকে বহিষ্কার!
              কারণ- 
তাঁর ছেলে দলের শৃঙ্খলা ভেঙেছেন!
হায়রে! ছেলের অপরাধে বাবা অপরাধী
                            এবং শাস্তিভোগী!

হঠাৎ আগুন!
কোথায় আগুন?
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং মলে আগুন!
জাঁকালো একুশ তলা ভবনের উপরের সাতটি তলা শেষ!
       'বসুন্ধরা গ্রুপের' প্রধান কার্যালয় শেষ!
এত আধুনিক ভবনের অগ্নিনির্বাপনের এই করুণ দশা কেন?
       সবার মনে আজ এ-ই প্রশ্ন।

আরও কত কত খবর!
       কত আলোচনা!
মুঠোফোনের এফ-এমের হেডফোন কানে।

হঠাৎ হুইসেল!
খেলার খবর!
কোটি টাকার 'পদবল' বা ফুটবল আসর ঢাকায়।
       খেলা বেশ জমে উঠেছে!
'লিভারপুল' ওদিকে হয়ে উঠেছে অদম্য।
কিন্তু প্রিমিয়ারশিপের টাইটেল?
       সে তো পাচ্ছে ম্যান ইউ।
আমার মত অনেকেরই তা-ই ধারণা।

সবশেষে 'উত্তাল মার্চ'।
দেশের স্বাধীনতার মাস
       মার্চ মাস।
এরই স্মরণে এবিসির প্রতিদিনকার আয়োজন।
       'উত্তাল মার্চ'।
আগ্রহভরে শুনি
       কারণ-
আমি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখিনি
আমি ত্রিশ লাখ শহীদ দেখিনি
আমি পাক হানাদার-যজ্ঞ দেখিনি।
 
       প্রতিবেদক বলে যায়-
সাত মার্চ'৭১ এর ভাষণের কথা,
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের কথা।
"এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।"
       -বলিষ্ঠ আহ্বান নেতার।

মেজর শফিউল্লাহ বলছেন
কিভাবে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা
পাকিস্তান আর্মি ভেঙে গড়ে তোলেন
       'বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী'।
কিভাবে পাক সেনারা এখানে শক্তি বাড়াতে থাকে
কিভাবে পাক সামরিক সরকার চোখে ধুলো দেয়
       সাত কোটি বাংলার মানুষের।

আজ একূশ মার্চ।
কালো রাতের বাকী আরো চারদিন।
আমি অপেক্ষায় আছি
কালো রাতের পরেরদিনের 'উত্তাল মার্চ' শুনব বলে।
       'একাত্তরের দিনগুলি' পড়ি
       আর অপেক্ষা করি
পঁচিশ মার্চ দুই হাজার নয়ের।
       কারণ-
আমি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখিনি।
আমি ত্রিশ লাখ শহীদ দেখিনি
আমি পাক হানাদার-যজ্ঞ দেখিনি।
মুঠোফোনের এফ-এমের হেডফোন কানে।


সিদ্ধেশ্বরী, ঢাকা
২১ মার্চ ২০০৯

পুনশ্চঃ

এই কবিতাটি গদ্যছন্দে লেখা। এই ছন্দটি রবি ঠাকুরের অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কীর্তি। এতে কোন ছন্দ থাকেনা। আধুনিক যুগের কাব্যের ছন্দোমুক্তি ঘটানোর জন্য যে সব পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে গদ্যছন্দ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। অমিত্রাক্ষর, গৈরিশ, মুক্তকের সম্মিলনে এর উৎপত্তি। এ ছন্দ যথাসম্ভব স্বাভাবিক ও কৃত্রিমতাশূন্য। শব্দের ও বাক্যাংশের সূক্ষ কারুকার্যের দিকে বেশি লক্ষ্য থাকে এই ছন্দে। আবেগময় গদ্য পরিত্যাজ্য।
রবি ঠাকুর বলেছেন,
"অশ্বারোহী সৈন্য ও সৈন্য, আবার পদাতিক সৈন্য ও সৈন্য- কোন্‌ খানে তাদের মূলগত মিল? -যেখানে লড়াই করে জেতাই তাদের উভয়েরই সাধনার লক্ষ্য।
কাব্যের লক্ষ্য হৃদয় জয় করা- পদ্যের ঘোড়া চডেই হোক, আর গদ্যের পা চালিয়েই হোক। সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির সক্ষমতার দ্বারাই তাকে বিচার করতে হবে। হার হলেই হার, তা সে ঘোড়ায় চডেই হোক, আর পায়ে হেঁটেই হোক।"

গদ্যছন্দ প্রবর্তনের প্রেক্ষিতে রবি ঠাকুর তার 'পুনশ্চ' কাব্যের ভূমিকায় বলেছেন-
"গীতাঞ্জলির গানগুলো ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করেছিলাম। এই অনুবাদ কাব্যশ্রেণীতে গণ্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, গদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝঙ্কার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কিনা। মনে আছে সত্যেন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলাম; তিনি স্বীকার করেছিলেন; কিন্তু চেষ্টা করেন নি। তখন আমি নিজেই পরীক্ষা করেছি, 'লিপিকা'র অল্প কয়েকটি লেখায় সেগুলো আছে। ছাপার সময় বাক্যগুলোকে পদ্যের মতো খন্ডিত করা হয়নি- বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ।"

এই আমি প্রথম এই ছন্দে কবিতা লিখলাম।